সাইবার হয়রানী ও নারীর নিরাপত্তা

ফেসবুকের ম্যাসেজ-এর মাধ্যমে হয়রানীর শিকার হয়নি এমন মেয়ে বোধহয় আমাদের দেশে খুবই কম সংখ্যক পাওয়া যাবে। এই হয়রানির থেকে সতর্ক থাকার ক্ষেত্রে আমি সাধারণত বাস্তবে পরিচিত না কেবল ফেসবুকের মাধ্যমেই পরিচয় এমন মানুষের ম্যসেজ হলে তখন তাকে ব্লক করে দেই তৎক্ষণাৎ। তবে যেসব ক্ষেত্রে আমরা ব্লক করেও স্বস্তিবোধ করতে পারিনা অথবা ব্লক করতে পারিনা সেগুলো হল সেই ব্যক্তি যদি নিজের সরাসরি পরিচিত একজন হন অথবা পরিচিতজনের আপনজন হন, সেক্ষেত্রে এই মানসিক ধকলের মাত্রা হয় কয়েকগুণ বেশি। এমন অভিজ্ঞতা অন্তত ২ বার হয়েছে আমার নিজের। প্রায় ৩ বছর আগে একজন খুব ঘনিষ্ট বান্ধবীর স্বামী যিনি তখন একটি টেলিভিশন মাধ্যমের চাকুরী ছেড়ে একটি নতুন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে চাকুরী শুরু করেছিলেন বলে বিজ্ঞাপন এবং লেখা দেওয়ার বিষয় নিয়ে যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। সেই লোক আবার দাড়িওয়ালা ধার্মিক পরিচয়ধারী ছিলেন বলে মাত্র কয়েকদিনেই বেশ আস্থা অর্জন করেছিলেন। সেই আস্থার সুযোগ তিনি নিতে চেষ্টা করেছিলেন এভাবে, আমার বান্ধবীর তখন ২য় বাচ্চা হয়েছে, সে খুব দুর্বল শরীরের একজন নারী হয়ে গিয়েছে। কাজেই আমার বান্ধবীর স্বামী অবলীলায় কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব আমাকে দিয়ে বসলেন। তবে যেই মাত্র তিনি বুঝলেন যে তিনি নিজের জন্যে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে এনেছেন এমন পরিচয় আমার কাছে প্রকাশ করেছেন তখন তিনি মুহূর্তের ভেতরে আমাকে ফেসবুকে আর ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে দেন। ভদ্রলোক কান্নাকাটি করে হাজারভাবে অনুরোধ করেন যেন আমার বান্ধবীকে আমি কিছু না জানাই। কথা দেইনা যে জানাব না। কেবল খুব দুঃখ অনুভব করেছিলাম আমার বান্ধবীর জন্যে যে মেয়েটা জানেনা যে তার কাছে ফেরেশতার রুপ নিয়ে ধর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলে যে স্বামী, তার প্রকৃত চেহেরা আসলে কি নোংরা কীট তূল্য!!

দ্বিতীয় যে উপায়ে ফেসবুক ম্যাসেজের মাধ্যমে হয়রানীর অভিজ্ঞতা হয় তা হল খুব আপত্তিকর কোন লিঙ্ক পাঠিয়ে থাকে পরিচিত এবং শ্রদ্ধাভাজন মানুষেরা। তাদের সাথে আমাদের শ্রদ্ধার সম্পর্ক বলেই হয়ত ভরসা নিয়ে লিঙ্কটা আমরা খুলে থাকি আর এভাবে হয়রানির শিকার হই। যদি তখন প্রশ্ন করা হয় যে এমন লিংক আমাকে কেন পাঠালেন? তার জবাবে তিনি খুব সহজভাবেই উত্তর দিয়ে থাকেন যে, এই লিঙ্ক তার কোন বন্ধু পাঠিয়েছেন, তিনি আবার তার সব বন্ধুদের পাঠিয়েছেন। এটা পড়ে অন্য কেউতো কোন আপত্তিকর বলে মনে করেনি তাহলে আমি কেন এতটা প্রতিক্রিয়াশিল হচ্ছি? এক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যায় আমি আধুনিক মেয়ে না, আমার জ্ঞান খুবই নীচু পর্যায়ের যে তার এমন উচ্চ পর্যায়ের শৈল্পিক লিংকের মূল্য আমি বুঝি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়রানিকারীব্যক্তির পরিচয় যদি কেবল সামাজিকভাবে পরিচিত হয় তবে এমন ধকল কেবল মানসিক পর্যায়ের ধকল তবে এই মানসিক পর্যায়ের ধকলের মাত্রা ছাড়িয়ে তা অনেক বেশি আতংকের ও শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছায় যদি এমন মেসেজকারি একজন সহকর্মী হন। বলাই বাহুল্য, বয়সে বড় পুরুষেরা স্বাভাবিকভাবেই একজন নারী সহকর্মীর থেকে উঁচু পদের সহকর্মী হয়ে থাকেন এবং সরাসরি লাইন মেনেজার হলে তখন কাছ থেকে এমন হয়রানির শিকার নারীকে অনেক বেশি পর্যায়ের লড়াই করতে হবে এ হয়রানির প্রতিকার করার জন্যে।

এই হয়রানির থেকে তাহলে বাঁচার উপায় কি?

আইনগত ভিত্তিঃ সবচেয়ে বড় ভরসা হল আমাদের দেশে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তবে আইন মানে মামলা এবং অনেক জটিল সব ধাপ এমন মনে করে যাতে একজন ভুক্তভোগী নারী ভয় পেয়ে আরো বেশি গুটিয়ে না যান সেকারণে বর্তমানে ফেসবুকসহ সাইবার ক্রাইমের জটিল সমস্যায় সেবা দিতে আছে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্র্যান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট নামের একটি বিভাগ।

যদি কোন নারী নিজের চাকুরীর প্রতিষ্ঠানের কারো দ্বারা এমন আপত্তিকর অভিজ্ঞতার শিকার হন তাহলে সবার আগে দরকার সেই নারীর চাকুরীর মানবসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালা ভালভাবে জানা। যদি এই নীতিমালায় লেখা থাকে যে এমন অন্যায় করলে তা “জিরো টলারেন্স”এর আওতায় বিবেচনা করা হবে তবে নিজের প্রতি ঘটে চলা অন্যায়ের সব প্রমাণ নিজের কাছে রেখে তবে অফিসকে বিষয়টি জানান দরকার।

একটা বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে এমন অন্যায়কারী যতবেশি শক্তিশালী মানুষই হন না কেন, এখানে অন্যায়কারী প্রমাণ রেখে চলেছে প্রতিটা সময়ে। কাজেই সঠিক উপায়ে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে এধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হলে অন্যায়কারী ব্যক্তির শাস্তি হবেই।

নিজেকে অসহায় মনে করে গুটিয়ে নিয়ে এমন ধরণের অন্যায়কে সহ্য করার মাধ্যমে কেবল নিজের প্রতিই অন্যায় করা হয়না, এটাতে এমন লোকেরা সাহস পেয়ে গিয়ে ক্রমাগত একের পর এক নারীদেরকে হয়রানী করতে থাকবে। কাজেই সঠিক সময়ে সব ম্যাসেজের প্রমাণ রেখে এমনকি কাছের কোন একজন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি বন্ধুর পরামর্শ নিয়ে এমনসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। তবে একটা কথা নিজেকেই মনে রাখতে হবে সব নারীদেরকে তা হল, এই ধরণের প্রতিবাদ করলে খুব কাছের মানুষেরা ছাড়া প্রায় সব পরিচিতজনেরা এমন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে চান না, নিজেকে খুব একটা নিরাপদ নারী অথবা পুরুষ হিসেবে বেশ দূরত্ব রেখে চলেন। তবে এমন বন্ধুরাও পাশে চলে আসেন যারা সত্যিকারের বিপদের সময়রে বন্ধু। যাতে এই লড়াই একজন নারী শক্তভাবে করতে পারেন। কেউ পাশে থাক অথবা না থাক, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে নিজের মানসিক দৃঢ়তা ধারণ করতে পারলেই এ লড়াই জেতা খুব সহজ একটা ঘটনা। কারণ এখানে সব কাজের প্রমাণ থেকে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *